রাত পোহালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এবারের নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম সন্ধিক্ষণ হিসেবে অভিহিত করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিসহ মিত্র রাষ্ট্র গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিশ্ব ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশটির এতদিন ধরে চলা দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের জন্য কঠিন পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনকে। যেখানে প্রেসিডেন্ট পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নেমেছেন দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন সাম্প্রতিক কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত কাটাচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতি। এক দিকে ইউরোপের ইউক্রেন-রাশিয়া, ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইতিহাসের নজিরবিহীন নির্মম ও রক্তাক্ত আগ্রাসন চালাচ্ছেন ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তার আগ্রাসন ঘিরে ইতোমধ্যে উত্তপ্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্য।
এদিকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে ইরান-ইসরাইল। অপর দিকে তাইওয়ান ঘিরে উত্তপ্ত দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব এশিয়া। এর পাশাপাশি অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদে আক্রান্ত সুদান, মালি, সোমালিয়া, কঙ্গো, বুরকিনা ফাসোসহ আফ্রিকার বহু দেশ।
শুধু ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে এসব ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রাজনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই ধরনের চিন্তাভাবনা করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী কমলা হ্যারিস জয়লাভ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের বর্তমানে অনুসৃত নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তন না-ও হতে পারে। তিনি যার রানিংমেট ছিলেন সেই জো বাইডেনের শারীরিক অসমর্থতার দরুন আকস্মিকভাবেই তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পেয়েছেন। বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতাই অক্ষুণ্ণ রাখবেন কমলা হ্যারিস। তবে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হতে পারে, যদি তার বদলে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এবারের প্রেসিডেন্সিতে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত কয়েক দশকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটাই প্রমাণিত। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এতদিন ধরে গুরুত্ব পেয়ে আসা “বৈশ্বিক নীতি”র বদলে তিনি গ্রহণ করতে পারেন “যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম” নীতি।
এদিকে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় দৃঢ়ভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প এই “যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম” নীতির পক্ষে খোলাখুলিই নিজের ধারণা তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ তার পররাষ্ট্র, অর্থনীতি ও যুদ্ধনীতি পরিচালিত হবে, “আগে যুক্তরাষ্ট্র, পরে অবশিষ্ট বিশ্ব” নীতিতে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ট্রাম্পের এই নীতির অর্থ হচ্ছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নেই, কিংবা তার স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, এ রকম ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে মিত্রদের স্বার্থকেও গুরুত্ব দিবেন না ট্রাম্প। আর ট্রাম্পের এই অবস্থানেই মূলত শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ গুলো। বিশেষ করে ক্রমেই আগ্রাসীরূপ ধারণ করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো।
এ ব্যাপারে কূটনৈতিক মহলে নানাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকরা নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরে আসছেন এসব দেশের কূটনীতিকরা। তাদের আশঙ্কা হয়তো রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে এমন কোনো বোঝা পড়ায় আসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মাশুল দিতে হবে ইউরোপে আমেরিকার মিত্রদের।
পাশাপাশি ব্যবসা ও রাজনীতির ময়দানে স্বাধীনচেতা স্বভাবের হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ও ওয়াশিংটনের আমলাদের দেখানো পথে না চলে নিজের ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নেবেন। এই ধরনের আশঙ্কা ও রয়েছে। ট্রাম্পের এই “অনিশ্চিত” স্বভাবের বিষয়টিই মূলত অনেক বেশি আতঙ্কিত করছে ইউরোপের কূটনীতিকদের। ট্রাম্পের আমলে ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের “ঘনিষ্ঠ মিত্র” হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পরিবর্তে “অনিশ্চিত মিত্র” হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এই আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।