আমরা যদি সত্যিকার অর্থে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতাম, তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় প্রতিটি খাদ্যপণ্যের জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীলতা বিভিন্ন সময়ে বিদেশি শক্তির চাপ বা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি শুধু অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বাংলাদেশ সোসাইটি অব এগ্রোনমির (বিএসএ) ২৩তম জাতীয় এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বাকৃবির সিন্ডিকেটের সদস্য, লাল তীর বীজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং মাল্টিমোড গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল মিন্টু।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন কক্ষে `টেকসই ফসল উৎপাদনের জন্য স্মার্ট এগ্রোনমি’ প্রতিপাদ্যে ঐ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ৫ জন বিশিষ্ট কৃষিতত্ত্ব গবেষক ও অধ্যাপককে বিএসএ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ২ শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেন।
আব্দুল আউয়াল বলেন, রাজনীতিবিদরা প্রায়ই দাবি করেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থনীতির বাস্তবতায় দেখা যায়, লবণ ও সবজি ছাড়া অধিকাংশ খাদ্যপণ্যে চাল, গম, ভুট্টা এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের জন্য আমরা এখনো আমদানি নির্ভর। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে চাল আমদানি করতে হয়নি। তবে এর আগের ১০ বছরে চাল আমদানি করতে হয়েছে। বর্তমানে চালের মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনায়, আগামী মে মাস পর্যন্ত ন্যূনতম খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে দুই থেকে আড়াই মিলিয়ন টন চাল আমদানির প্রয়োজন হতে পারে। বছরে আমাদের প্রায় ৯০ লাখ টন গম প্রয়োজন, কিন্তু উৎপাদন হয় মাত্র ৫ থেকে ৬ লাখ টন। ভুট্টার প্রয়োজনও প্রায় ৯০ লাখ টন, তবে উৎপাদন হয় মাত্র ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন, ফলে আমদানি করতে হয় প্রায় ৩০ লাখ টন।
আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, কৃষি রূপান্তরের সঙ্গে শিল্পায়ন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে কৃষিকাজে প্রতি বছর কর্মীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তারা চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে এবং নগরায়ণের দিকে ঝুঁকছে। তবে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই, কারণ খাদ্যের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি কৃষিকে শিল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে যুক্ত করা না যায়, তাহলে কৃষির কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর সম্ভব হবে না।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে কৃষিতে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা বিরাজমান। উন্নত দেশের সাথে আমাদের কৃষি কাঠামোর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল প্রথমে নিজেদের চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করেন। তাদের অধিকাংশই ছোট ও প্রান্তিক কৃষক, যাদের আর্থিক ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য কম। তারা পুরোনো পদ্ধতিতে চাষাবাদে বিশ্বাস করেন এবং কৃষি পণ্যের বাজারের অস্থিরতার কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হন না।
আব্দুল আউয়াল মিন্টু আরো বলেন, আমাদের খাদ্যে সত্যিকারের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব না হলেও একই জমিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি ফসল উৎপাদন করা যায়। জিন প্রযুক্তি, উন্নত বীজ এবং আধুনিক সেচ পদ্ধতি কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সম্মেলন উপলক্ষে ৭ ও ৮ ডিসেম্বর মিলে মোট ৮টি টেকনিক্যাল সেশন ও একটি পোস্টার সেশন অনুষ্ঠিত হবে। এসব সেশনে মোট ২০৫টি গবেষণা প্রবন্ধের ফলাফল উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে ১০০টি মৌখিক ও ১০৫টি পোস্টার উপস্থাপনা।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব এগ্রোনমির সভাপতি ড. নূর আহমেদ খন্দকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. ময়নুল হক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম শিকদার, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. হুমনাথ ভান্ডারী এবং এফএও বাংলাদেশের সিনিয়র কারিগরি উপদেষ্টা সাসো মার্টিনভ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব এগ্রোনমির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. আবদুল কাদের।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্মার্ট এগ্রোনমির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং জলবায়ু সহনশীল পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া।
ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, মাটির উর্বরতা হ্রাস, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট এগ্রোনমি কার্যকর সমাধান দিতে পারে।’