বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই শেরপুরে চলছে অবাদ চাঁদাবাজি। নানা কৌশলে চলছে এমন কর্মকাণ্ড। বিষয়টি এখন জেলাবাসীর মুখে মুখে ফিরছে। ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিগত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী কারও যেন নিস্তার নেই এই চাঁদাবাজদের হাত থেকে। এর ফলে বড়-ছোট ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে লাখ, আবার লাখের গণ্ডি পেরিয়ে কোটি টাকা চাওয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর নির্দেশে তার কিছু লোক এসব চাঁদাবাজি করে আসছে। চাঁদা দিতে কেউ অপারগ হলে তাকে মামলায় তালিকাভুক্ত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে হযরত আলী নীরবে এসব চাঁদাবাজি করছেন। বিষয়টি শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামেগঞ্জে, হাট-বাজারেও প্রতিদিন কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে হযরতের নির্দেশে। তবে এত কিছুর পরেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অর্থের বিনিময়ে নিজেদের রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিগত বছরগুলোতে নিজেদের কুকর্ম ঢাকতে প্রভাবশালী এসব চাঁদাবাজদের ম্যানেজ করেই জনসম্মুখে চলছেন তারা। শুধু তাই নয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরাসরি বিরোধিতাকারী আওয়ামী সমর্থিত নেতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখছেন সাধারণ মানুষ।
শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুরে নিভৃত পল্লিতে অবস্থিত মুর্শিদপুর পাক দরবার শরিফের খাজা মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা হায়দার ওরফে দোজা পীর। সুউচ্চ সীমানা প্রাচীর ঘেরা ২৫০ একর জমিতে লাগানো রয়েছে নানা ধরনের গাছ। সম্প্রতি এই পরীরে আস্তানা বন্ধ করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে হেফাজত ইসলামসহ অনেক নেতা-কর্মী। কিন্তু দোজা পীরের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সেই আস্তানা বহাল রাখতে চায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী। এ নিয়ে হেফাজত ইসলামের সদস্যরা এর প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা হেফাজত কর্মীসহ অন্য নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এ ছাড়া অনেককে ভয় দেখিয়ে জমি দখল, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে হযরত আলীর বিরুদ্ধে।
এদিকে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি (শেরপুর-৩ আসন) মাহমুদুল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর বিরুদ্ধে সেনাপ্রধানসহ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ দিয়েছে জয়নাল আবেদীন নামে এক ধান-চাল ব্যবসায়ী। এমন এক চিঠি খবরের কাগজের হাতে এসেছে। চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী শেরপুরে থাকা মিল-কারখানা, গার্মেন্ট, দোকানপাট ও মুদির দোকান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ভয়ে অনেকেই টাকা দিচ্ছে। কিন্তু টাকা না দিলে হত্যা মামলায় নাম বসিয়ে টাকা আদায় করছে। তাদের একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রতিদিন ছাত্রদল, যুবদলের সন্ত্রাসীরা বিভিন্নজনের বাসায়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করছে। পরে মানুষ বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে।’
চাঁদাবাজির শিকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে প্রতিবেদককে বলেন, কার বিচার, কাকে দেব? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পুরোদমে মাঠে নেই। কোথায় অভিযোগ করলে প্রতিকার পাওয়া যাবে, সেটাও জানা নেই। এ ছাড়া অভিযোগ করলে বিপদ আরও বাড়তে পারে। তাই বাঁচার জন্য অনেকেই চুপ থাকছেন।
মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া ভুক্তভোগী রিয়াজুল ইসলামের ভাই সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মামলায় আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে বিএনপির নেতারা। অথচ আমার ভাই কুমিল্লাতে চাকরি করে। সে কোনো রাজনীতি করে না।’
এদিকে তাবলিগ নেতা সানি বলেন, ‘দোজা পীরের দরবারে বাজে কাজ হয়। এজন্য আমরা সেটি বন্ধের জন্য আহ্বান করি। কিন্তু এখন শুনছি রাজনীতি নেতা-কর্মীরা সেটি (দোজা পীরের দরবার) বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে।’
শহরের নবীনগর পানাতিয়াপাড়ার বাসিন্দা মৃত শরাফত আলীর ছেলে বেলায়েত হোসেন বিল্লাল বলেন, ‘১৯৬২ সালে আমার নামে কেনা হয় ২ একর ৪৩ শতাংশ জমি। ক্রয় সূত্রে ওই জমির বৈধ মালিক আমি। কেনার পর থেকেই সেই জমি আমি ভোগ-দখল করে আসছি। কিন্তু গেল ৯ আগস্ট হঠাৎ করেই জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী ৪০০-৫০০ সশস্ত্র লোক নিয়ে আমার ১ একর ২৬ শতাংশ জমি দখল করে নেয়। শুধু তাই নয়, ওই জমির মালিকানা দাবি করে নিজের নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এলাকায় মাইকিং করে প্রচার করেছে, এই জমি তার।’
জেলার সমাজসেবক রাজিয়া সামাদ ডালিয়া চাঁদাবাজদের বিষয় বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে জেলাজুড়ে চাঁদাবাজির ধুম পড়ে গেছে। মানুষ নীরব চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। এখনো চলছে। এর অবসান হওয়া দরকার। আমি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কয়েকবার বৈঠক করেছি। তাদের বলেছি, এগুলো বন্ধ করেন। চাঁদাবাজি যারা করছে তাদের ধরুন। আমার সন্দেহ হয়, এই চাঁদাবাজির পেছনে হয়তো বিএনপি কাজ করছে!’ এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।