জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন প্রায় চার বছর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় হারান দলীয় পদ। এক পর্যায়ে নগর পিতার পদও যায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদকের। এর পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠছে। মিলছে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ! এবার তথ্য পাওয়া গেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের। পছন্দের ১০ ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই বানিয়েছেন ভুয়া ভাউচার, তুলেছেন বরাদ্দের পুরো অর্থ। এভাবে তাঁর মেয়াদে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি সংস্থাটির অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধান নথি থেকে জানা গেছে, সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের ২০১৮-২১ মেয়াদে ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ খরচে দুর্নীতি হয়নি বলে তথ্য-উপাত্ত বলছে। অন্যদিকে সরকারি অর্থায়নের কাজ না করে ভুয়া কাগজপত্রে বাস্তবায়ন দেখিয়ে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীনে ১ হাজার ২০০ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম মেয়র থাকা অবস্থায় রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার, কালভার্ট তৈরি, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমার মাঠ সংস্কার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ নানা কাজ দেওয়া হতো পছন্দের ১০ প্রতিষ্ঠানকে। তারা তাঁকে বিশেষ সুবিধা দিত। তিনি তাদের ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতেন না। ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
ওই ১০টি প্রতিষ্ঠান হলো– মেসার্স আদিতা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আমিনুল এন্টারপ্রাইজ, রয়েল ট্রেড এন্টারপ্রাইজ, ডেল্টা এন্টারপ্রাইজ, এমআর ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এস কন্সট্রাকশন, আমিনুল এন্টারপ্রাইজ, জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিং, কেএল ওয়েল্ডিং ও মা এন্টারপ্রাইজ।
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগ
সাবেক এই মেয়রের বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্যগুলো দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক আলী আকবরের নেতৃত্বে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সেই অনুসন্ধানী দলের সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীরে বিরুদ্ধে আরও অনেক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো– করোনা মহামারির সময় প্রতিষেধক ও খাদ্যসামগ্রী কেনার নামে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ। গাজীপুরে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ সংস্কারের নামে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ২২ হাজার ৫৫৮ টাকা খরচ দেখিয়ে লোপাট। সিটি করপোরেশন ভবনের (নগর ভবন) লিফট এবং এসি স্থাপনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ। উন্নয়ন তহবিল থেকে রাজস্ব তহবিলে বেআইনিভাবে ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা স্থানান্তর। আইন অনুযায়ী উন্নয়ন তহবিলের টাকা টেন্ডারের মাধ্যমে খরচ করার কথা থাকলেও তা হয়নি।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়। এর পরিপ্রক্ষিতে তিন মাসের মাথায় ১৯ নভেম্বর তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ২৫ নভেম্বর হারান মেয়রের পদও।
আসন্ন ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। ঋণখেলাপির অভিযোগে নির্বাচন কমিশন তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। তিনি প্রার্থিতা বহাল রাখার অনুরোধ জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলে কমিশন তা বাতিল করে দেয়। পরে জাহাঙ্গীর প্রার্থিতা ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেন। উচ্চ আদালত তাঁর এ আবেদন খারিজ করে দেন।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঠিকাদারি কাজে মেয়রের অর্থ আত্মসাৎ করার কোনো সুযোগ নেই। এসব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে পিডি থাকেন, সংশ্লিষ্ট আরও কর্মকর্তাও থাকেন, তাঁরা বিষয়টি দেখভাল করেন। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দুদকে দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তি নেই। এসব মিথ্যা অভিযোগ। তিনি দাবি করেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তাবায়ন হয়নি। তাঁর মেয়াদে বৃহৎ অঙ্কের সরকারি অর্থায়নে উন্নয়ন কাজও হয়নি।