একের পর এক সংকট লেগেই আছে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে। জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অস্থিরতা, এরপর সংঘর্ষ ঘিরে সরকারের জারি করা কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন—সবমিলিয়ে পোশাক খাতে ছিল চরম অস্থিরতা। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও নতুন করে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যার বড় প্রভাব পড়েছে এই শিল্পে। এ ছাড়া ৪ লাখ টাকা সীমা নির্ধারণ করায় ব্যাংক লেনদেনে দুর্ভোগ, এলসি জটিলতা, বন্যায় ভাঙা সড়কে পণ্য পরিবহনে লোকসান, আগস্টের বেতন নিয়ে শ্রমিক অস্থিরতাসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে কথাও বলেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতারা। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতেও শুরু করেছে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্রুত এই সংকট থেকে উত্তরণে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৬৩৮টি নিবন্ধিত তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই খাতটির মাধ্যমেই আয় হয় বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু নানা সংকটে বর্তমানে খাতটি জর্জরিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওভেন পোশাক রপ্তানি এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমে ১৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় আসা নিটওয়্যারের রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত অর্থবছর এ খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশি ক্রেতারা সাধারণত জুলাই ও আগস্টে কার্যাদেশ দেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এখন তারা সতর্ক। ভালো দিক হলো ক্রেতারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়াবে।
প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর কালবেলাকে বলেন, দুই মাস ধরে চলমান অস্থিরতা পোশাক খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হচ্ছে। তিনি জানান, চট্টগ্রামের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করে, আমদানি-রপ্তানির জন্য এলসিগুলোও তাদের মাধ্যমে করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের সৃষ্ট ইস্যু নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। কিন্তু ক্ষতি কাটিয়ে রপ্তানি সচল রাখতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিজিএমইএ নেতারা এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়েছেন। বর্তমান সরকার যথেষ্ট সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছে, যা এই শিল্পের জন্য ভালো একটি দিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, সময়টা এখন শিল্প মালিকদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। একের পর এক সংকটের কারণে অনেক কারখানা মালিক পণ্য রপ্তানি করতে পারেননি। এসব কারখানা মালিকের পক্ষে আগস্ট মাসের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বেতন দিতে না পারলে ওইসব কারখানা শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারেন। এতে শিল্পে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এখনো যেহেতু পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ সাপোর্ট মিলছে না; তাই কোনো অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে পারে। এজন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি, যাতে আগামী মাসে বেতন নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি না হয়।
ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ছাত্র আন্দোলন, কারফিউ জারি, ইন্টারনেট বন্ধ, শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ নানা ইস্যুতে অনেক শিল্প মালিক সময়মতো বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারেননি। সেই সংকট কিছুটা কাটতে না কাটতেই শুরু হওয়া বন্যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নেওয়াও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এখনো অনেক কারখানা মালিক সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। এই উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি, সেসব প্রতিষ্ঠানে আগস্ট মাসের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে লেনদেনের যে সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে, তাতেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রতিদিন আমাদের মতো একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন করে। কিন্তু এখন ৪ লাখ টাকা লিমিট করা হয়েছে, যা আমাদের জন্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এই বিষয়টিতে আরও জোর দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক ও চট্টগ্রামের বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুল ইমরান খান কালবেলাকে বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরের সঙ্গে রিলেটেড সাপ্লায়ার, ডায়িং মিলস ফ্যাক্টরিগুলোকে এলসি দিতে খুব সমস্যা করছে ব্যাংকগুলো। বাস্তবতা হল বিভিন্ন অজুহাতে এলসি দিচ্ছেই না তারা। এই ঘটনায় এখনই হয়তো পোশাক শিল্পে প্রভাব পড়ছে না। কিন্তু শিগগিরই এই ঘটনার একটি প্রভাব পড়বে পোশাক শিল্পে। ব্যাংকে বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের (ব্যাংক) এক দিন আগে জানিয়ে দিলে তারা পেমেন্ট দিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বোধ হয় বড় সমস্যা হচ্ছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সীমা (ইডিএফ) আরও কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই সংকটময় সময়ে ইডিএফের সীমা আরও কমিয়ে আনা হলে ব্যবসায়ীরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিজিএমইএ নেতারা বাংলাদেশের রপ্তানি পারফরম্যান্স ধরে রাখতে ইডিএফের সীমা আর না কমানো এবং পোশাক শিল্পের জন্য তপশিলি ব্যাংকের মাধ্যমে ইডিএফ তহবিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অ্যাক্সেস প্রদানের জন্যও গভর্নরকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
বিজিএমইএর সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে এসব প্রতিষ্ঠানের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের এক মাসের মজুরির সমপরিমাণ অর্থঋণ সহজ শর্তে প্রয়োজন। এই ঋণ পেলে, তা সুদসহ আগামী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।