কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের টালবাহানা, ২০১৮ সালের আন্দোলনকারীসহ বর্তমান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ধারাবাহিক মিথ্যাচার, বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে আজকে সংবাদ সম্মেলনে করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০১৮ এর নেতৃবৃন্দরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০১৮ এর সংগঠক মোঃ রাশেদ খাঁন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে ২০১৮ সালের মীমাংসিত বিষয় সামনে এনে চলমান লুটপাট, আর্থিকখাতের বিপর্যয়, আজীজ- বেনজীর- আসাদুজ্জামান -মতিউরদের দুর্নীতি, ভারতের সাথে রেলচুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন একটি সফল ছাত্র আন্দোলন। ঐবছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ৮ এপ্রিলে থেকে জোরালো আন্দোলনে পরিণত হলে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, আর কোন কোটা থাকবেনা, যেহেতু সংস্কার করলে আবার আন্দোলন হবে, তাই কোটা বাতিল করা হবে।
এরপর ঘোষণার দেড় মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশ করা হচ্ছিলোনা। যেকারণে ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। কিন্তু সেখানে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে সংবাদ সম্মেলন বানচাল করে দেয়। সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠক নুরুল হক নুর, হাসান আল মামুনসহ বেশ ক’জন গুরুতর জখমের শিকার হয়। এরপর থেকে সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার ও দমনপীড়নের শুরু করে সরকার। ২ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারীদের লাঞ্ছিত করা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুলকে হাতুড়ি পিটা করে পা ও মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যেখানেই আন্দোলন করতে যায়, সেখানেই হামলা চালানো হয়, এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছাত্রলীগের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়। গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থী রাশেদ খাঁন, ফারুক হাসান, মশিউর রহমান, মাহফুজুর রহমান, জসিম উদ্দিন, রাতুল, সুহেলদের মুক্তির জন্য অভিভাবকরা রাজপথে নেমে আসছে। এতো দমন-পীড়নের পরেও কোটা সংস্কার আন্দোলন বন্ধ করা যায় নি। অবশেষে সরকার বাধ্য হয়ে ৪ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে। এরমাধ্যমে ছাত্রসমাজের কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণ হয়।
আমরা সেসময়ে কোটা বাতিল নয় বরং কোটা সংস্কার চেয়েছিলাম। সেসময় ২ জুলাই সরকার তৎকালীন মন্ত্রীপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতপ ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেডে কোটা বাতিল করে মেধারভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু গত ৭ জুলাই ২০২৪ ইং তারিখে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোটা বাতিল আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই। তাহলে তিনি কেন বাতিল করার কথা বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা তো বাতিল চায়নি।
গত ২০২১ সালের একটি রিটের প্রেক্ষিতে গত ৫ জুন ২০২৪ ইং তারিখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে সারাদেশে আবারও কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গত ১০ জুলাই আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন। এরমধ্যেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। গত ৮ জুলাই ২০২৪ ইং তারিখে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আগে যে কোটা আন্দোলন বাংলাদেশে হয়েছিল সেখানকার প্রথম সারির ৩১ জন নেতা তারা কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।’
ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি গত ১৩ জুলাই বলেছেন, ‘২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনকারীদের একজনও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।’
এছাড়া গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,
‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে?
সরককারের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে এমন বক্তব্য কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৮ সালে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছে, তারাই পরবর্তীতে মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে। যারা সংগঠক পর্যায়ে ছিলেন, তাদের নামে মোট ৬ টি মামলা দেওয়া হয়। যে মামলাগুলোতে তাদের এখনো হাজিরা দিতে হচ্ছে, কোন কোন মামলায় চার্জশিট দিয়েছে, বিচার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে যেখানে পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের নামে হয়রানি করা হয়, সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠকদের চাকরি পাওয়ার কোন সুযোগ রাখা হয়েছে? বরং তারা যাতে চাকরি না পায় এজন্য তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন -২০১৮ এর সংগঠকরা নিজেদের একাডেমিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে, হাজারো শিক্ষার্থীর কোটামুক্ত চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করেছে। তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন করে এখন রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামতের কাজে নিযুক্ত হয়েছে। যারা সংগ্রাম করে, তারাই সবসময় ভোগ করবে, এটি তো কোন আন্দোলনের শর্ত হতে পারেনা। বরং এটিই হয়ে আসছে, যারা ত্যাগ করে তারা ভোগ করতে পারেনা।
আর ছাত্রলীগের সভাপতি ৯ বছরে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। এরমধ্যে ৫ বছরই তিনি ফেল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী যার ছাত্রত্বই থাকার কোন সুযোগ নেই, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কেউ চাকরি পায়নি বলে মিথ্যাচার করেছে। সারাদেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছে, তাদের অধিকাংশ এখন চাকরি করছে।
২০১৮ সালে যারা আন্দোলন করেছে, ২০২৪ সালে যারা আন্দোলন করছে, তাদের কারওই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ক্ষোভ নেই। বরং সরকার তার নিজের সুবিধার জন্য বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করার দাবি আমরা সবসময় জানিয়েছি। বিদ্যমান বাস্তবতায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা যৌক্তিকহারে সংস্কার করা যেতে পারে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোটা সুবিধা বাস্তবসম্মত নয়। যেটি অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও বলছেন, আমরা কোটার জন্য যুদ্ধ করিনি, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে দেশ স্বাধীন করেছি। এছাড়া সংবিধানের ১৯(১), ২৯(১),২৯(২) অনুচ্ছেদে চাকরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা আছে। সুতরাং কোটা ব্যবস্তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করেছিলাম। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে থেকে রাগ-ক্ষোভের বশীভূত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না, প্রধানমন্ত্রী কাছে সেই প্রশ্ন রেখে গেলাম।
২০১৮ সালে যারা আন্দোলন করেছে, তারা আওয়ামীলীগের অফিসে হামলা, কোন মানুষের উপর হামলা করেনি। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সঠিক নয়।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এই দেশে কারা রাজাকারের নাতিপুতি? তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য রাজকারের নাতিপুতি শব্দচয়ন করে আন্দোলনকারী লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের অপমান করেছেন, তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান করছি।
প্রধানমন্ত্রীর গতকালের বক্তব্য এবং হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর ভাষার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশের বিচারবিভাগ কতোটুকু স্বাধীনতা?
কোটা নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এটা কাদের ইশারায় হচ্ছে, সেটি গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। আর গতকাল হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন করতে পারবে। ২০১৮ সালে তো সরকারই পরিবর্তন করেছে। নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত ও রাজপথের আন্দোলনের ফলাফলকে হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া বিচারবিভাগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা বলে আমরা মনে করি।
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, আমরা এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি। তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান, ২০১৮ সালে অসংখ্য শিক্ষার্থী ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সফলতা ধরে রাখা আপনাদের দায়িত্ব। আমরা আপনাদের সাথে রয়েছি, ইনশাআল্লাহ আপনারা সফল হবেন, ছাত্র আন্দোলন কখনোই বৃথা যেতে পারেনা। একইসাথে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে পুলিশি মামলা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি। সরকারকে বলবো, শিক্ষার্থীদের উষ্কে না দিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার না করে, তাদের প্রতি অপমানমূলক শব্দ প্রয়োগ না করে তাদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে করার সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর হামলার বিষয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে রাশেদ খান বলেন, ২০১৮ সালে আমাদের উপর হামলা হলে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। যেকারণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করুন। আপনারা সংখ্যায় বেশি। আপনাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে বিজয় আপনাদেরই হবে, ইনশাআল্লাহ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০১৮ এর সংগঠক শাকিল উজ্জামান, শহিদুল ইসলাম ফাহিম, আব্দুজ জাহের, শহিদুল ইসলাম, কাওসার আলি প্রমুখ।