চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মধ্যরাতে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রোববার (১৪ জুলাই) দিনগত রাত ১১টার দিকে ঢাবির বিভিন্ন হল থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বেরিয়ে এসে ক্যাম্পাসে মিছিলের ঢল নামায়। তবে বিক্ষোভ শুরু হয় এদিন রাত ১০টার দিকে বিভিন্ন হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিলের মাধ্যমে।
জানা যায়, রোববার (১৪ জুলাই) গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কোটা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিরা পাবে?’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে রাতেই উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ‘রাজাকার’ স্লোগানে প্রকম্পিত করেন পুরো ক্যাম্পাস। ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদিন সন্ধ্যা থেকেই লেখালেখি করতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে। অতঃপর রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছোট বড় মিছিল নিয়ে এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সন্ধ্যা থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টার দিকে বিভিন্ন হলে প্রতিবাদ মিছিল করে তারা। ১১টার দিকে বিভিন্ন হলের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এসে জড়ো হয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। আধা ঘণ্টা পর একটি মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান করেন। কিছুক্ষণ পর পুনরায় একটি অংশ রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ফিরে যায়। এভাবেই রাত জেগে শিক্ষার্থীরা মোবাইলের ফ্লাশলাইট জালিয়ে, খুন্তি ও বোতল বাজিয়ে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। এসময় ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগানও দিতে দেখা যায় তাদের।
শিক্ষার্থীদের এমন প্রতিবাদ ভালোভাবে নেয়নি ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের প্রতিবাদে নামা বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একই সময়ে গভীর রাতে মিছিল নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে জড়ো হয়। তবে বড় ধরনের কোনো হামলায় জড়াননি তারা।
শুরুতে ছাত্রদের হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হলেও কিছু সময়ের মধ্যেই রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, সুফিয়া কামাল হলসহ নারী শিক্ষার্থীদের প্রায় সকল হল থেকে হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থীরাও রান্নার কাজে ব্যবহৃত খুন্তি, খালি পানির বোতল বাজিয়ে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হতে থাকে। এসময় রোকেয়া হলের এক শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, আমরা একটি যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করে আসছি। আমাদের এই আন্দোলনে লাখ লাখ তরুণ তরুণী একাত্মতা পোষণ করেছে। তাছাড়াও যেকোনো ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং সাংবিধানিক অধিকারের জায়গা থেকে ন্যায্য দাবিতে আমাদের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে পরোক্ষভাবে রাজাকারের নাতি বলা হয়েছে। তারই প্রতিবাদে আমাদের এই বিক্ষোভ।
রাত দেড়টা পর্যন্ত কয়েক শ ছাত্রছাত্রী টিএসসিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যান। দেড়টার পর ছাত্রীরা নিজ নিজ হলে ফিরে যান। পরে ছাত্ররাও তাঁদের হলে ফিরতে থাকেন। এদিকে রাত দু্টইটার দিকে বুয়েটের কয়েক শ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। টিএসসি ঘুরে তাঁরা মিছিল নিয়ে আবার নিজেদের ক্যাম্পাসে ফিরে যান। এর আগে রাত দেড়টার দিকে হলের তালা খুলে নীলক্ষেত অভিমুখে যাত্রা করেন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারাও ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়।
শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভের দানা বাঁধে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে। এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের তিনজন নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সংগঠন থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপসম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ এবং আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে জিম।
রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হওয়া শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী টিএসসিতে আসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত থেকে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের হতে দিচ্ছিলেন না- এমন সংবাদ শুনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর সমন্বয়করা ঘটনাস্থলে গেলে তাদের উপর হামলা করে ছাত্রলীগ। হামলায় অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ আহত হয়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যখন শেষের দিকে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেও কয়েকটি দলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেখা যায়। সবাই এসে ডাকসু ভবনের সামনে জড়ো হয়ে রাজাকার বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। পরে রাত ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে একটি সমাবেশ করে সংগঠনটি। এসময় সোমবার (১৫ জুলাই) থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রাজাকার থাকবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। পরে রাত পৌনে ৪টায় সমাবেশ শেষ করে রাজু ভাস্কর্য ত্যাগ করে তারা।
অন্যদিকে গভীর রাতে এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে প্রক্টর প্রফেসর ড. মাকসুদুর রহমানের ফোন নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় কতৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের দাবি, রাত প্রায় ১১টা থেকেই ৪-জি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকে। যা রাত ৪টায়ও সচল হয়নি। এছাড়া মোবাইল ফোনে কল করার মতো নেটওয়ার্কও পায়নি অনেকে।