সড়কেই আরও এক দুপুর দীর্ঘ হল রাজধানীবাসীর; চলতি পথে যানজটে আর গরমে নাস্তানাবুদ হতে হল তাদের। গন্তব্যে যেতে এক জায়গাতেই কেটে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তবুও যেন গাড়ি এগোয় না, পথ ফুরোয় না।
রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্ম দিবসেই কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের গণপদযাত্রা ও সমাবেশের কারণে যানজটের এমন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সড়ক ছিল শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে।
এর রেশ ধরে রাজধানীর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ ছিল প্রায় চার ঘণ্টা। এসব সড়কের সঙ্গে যুক্ত অন্য সড়কগুলোতেও গাড়ির চাপ বেড়ে এক পর্যায়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এদিন বেলা ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে কোটা আন্দোলনকারীদের পদযাত্রা শুরু হয়। শাহবাগ, মৎস্য ভবন হয়ে সচিবালয়ের সামনে দিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। কয়েকদফা পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি হয় তাদের মিছিল। এরমধ্যেই ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগিয়ে গেছে বঙ্গভবনের দিকে; যা গিয়ে থামে গুলিস্তানে। তবে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ না করায় কোনো সংঘাত হয়নি।
গণপদযাত্রা শেষে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল দুপুর ৩টায় বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়। এরপর গুলিস্তানে সমাবেশ করে তারা। পরে সাড়ে ৩টার দিকে সমাবেশ শেষ করে ক্যাম্পাসের দিকে চলে গেলে বিকাল ৪টার পর থেকে রাস্তা সচল হতে শুরু করে।
আন্দোলনকারীরা সড়ক ছেড়ে দিলেও যানজটের জের ছিল আরও অন্তত দুই ঘণ্টা। অফিস ছুটির পর সচিবালয় থেকে বের হওয়া গাড়িগুলো নতুন করে যানজটে আটকা পড়ে।
এদিন দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর জিরো-পয়েন্ট গুলিস্তানমুখী সড়কগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যানজট ছড়াতে থাকে। বিকাল ৩টার দিকেও তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে মগবাজার হয়ে গুলিস্তানমুখী সড়কে সারি সারি গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিছু সময় পরপর গাড়ির চাকা সচল হলেও একটু এগোনোর পরই তা থেমে যায়।
এর প্রভাব পড়ে গুলিস্তান থেকে মহাখালী, বিমানবন্দর, মিরপুর, গাবতলী, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীসহ সবগুলো সড়কে। ভ্যাপসা গরমে বাসে বসে থাকতে না পেরে অনেক যাত্রীকে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে দেখা যায়।
তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিল গাজীপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী প্রভাতি বনশ্রী পরিবহনের একটি বাস। বিকাল ৩টার দিকে বাসের চালক আব্দুল জব্বার বলেন, “গুলিস্তান ফ্লাইওভার (যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক) বন্ধ করেছে পুলিশ। কোনো গাড়ি নামতে পারে না। পল্টন মোড়ে সব গাড়ি আটকা হুনলাম (শুনলাম)।”
হাতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে ট্রিপ শেষে দুপুর আড়াইটার দিকে গুলিস্তানে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ছিল তার। অথচ ৩টার দিকেও সাতরাস্তা পেরোতে পারেননি। কখন গুলিস্তান পৌঁছাতে পারবেন সেটি বুঝতেও পারছেন না।
সড়কে চালক জব্বার যখন যানজটে পড়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন সেই সময়ে দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান প্রবাসী জয়নাল আবেদিনকে। ফ্লাইট মিস করার ভয়ে ছিলেন তিনি। ৫ মাস দেশে ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন তিনি।
রাজধানীর সাইনবোর্ড থেকে বাসে রওনা হয়ে দুই ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারের বেশি যেতে পারেননি তিনি। একটু পর পর রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল চালক এক চাচাত ভাইকে বারবার ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন রাস্তায় যানজট কেমন, কখন সড়ক সচল হবে। ঠিক সময়মত বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারবেন কি না।
জব্বার বলেন, রাত ৮টায় ওমানগামী ফ্লাইট ছাড়বে তার। ৬টার মধ্যে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। বিকাল ৪টাতেও সড়কে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায় অনিশ্চিয়তা পেয়ে বসে তাকে।
যাত্রীদের পাশাপাশি মোটরসাইকেলের মাধ্যমে রাইড সেবাদাতা চালকরাও যানজটে পড়ে বিরক্ত একই স্থানে দীর্ঘ সময় চলে যাওয়ায়।
পরের ট্রিপে ভাড়া দ্বিগুণ হাঁকার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে চালক হাসিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে বের হয়ে ৫০০ টাকার ভাড়া তুলতে পেরেছি। দুটি ট্রিপের পর এখন তৃতীয় বারে পল্টন থেকে মহাখালী যাচ্ছি। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা লাগার কথা, অথচ প্রায় দুই ঘণ্টায় অর্ধেক পথ সাতরাস্তা আসলাম।”
এর আগে দুপুরে কোটা আন্দোলনকারীদের পদযাত্রা যখন মৎস্যভবন অতিক্রম করছিল তখনও আশপাশের তোপখানা রোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, সেগুন বাগিচা, কাকরাইল, বেইলি রোড, হেয়ার রোড, পুরানা পল্টন, বিজয় নগর এলাকায় যানজট তৈরি হয়।
কাকরাইলের মোড়ে সিএনজি চালক হাফিজ বলেন, “১২টা থেকে যানজটে পড়েছি। প্রথম ভেবেছিলাম সিগনাল। পরে জানলাম ভিআইপি মুভমেন্ট। ভিআইপি মুভমেন্ট শেষ হওয়ার পরও পুলিশ ছাড়ে না। পরে এক পুলিশ বলল, ‘ভাই আজকে খবর আছে। বসে থাকেন। কোটা আন্দোলনকারীদের মিছিল চলছে। দেরি হবে।’”
সরকারি একটি প্রকল্পের গাড়িচালক সুমন বলেন, আন্দোলনকারীদের মিছিল যাওয়ার পরই তিনি গাড়ি নিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ধরার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। ৬টা পর্যন্ত রমনা পার্কের কোণা পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। প্রচণ্ড যানজট।
পুলিশ ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করছে
পদযাত্রা শেষে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী আন্দোলনকারীরা বিকালে গুলিস্তানে সমাবেশ করে। সেখানে অবস্থান করা ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যেন কোনো সংঘাত না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। তার নির্দেশে পুলিশ সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।
যানজটে জনদুর্ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এ পরিস্থিতিতে যানজট নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির ট্রাফিক সদস্যরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এজন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। যানজট কমিয়ে জনগণকে কীভাবে স্বস্তি দেওয়া যায় সে বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে।